ইরান-খামেনি কেন থামেনি?

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি।


চলমান ইরান-ইসরায়েলের সংঘাতে উভয় দেশেরই বহু মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে— ইরানের একাধিক বিশেষ ব্যক্তিবর্গের মৃত্যুর ঘটনা, যা চলমান পরিস্থিতিকে আরও উত্তেজনায় পৌঁছেছে।

ইসরায়েল-আমেরিকার অভিযোগ অনুযায়ী, ইরান কোনোদিন পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকার হতে পারবে না। মূলত এই সূত্র ধরেই চলমান সংঘাত আরও ডালপালা ছড়াচ্ছে।

এদিকে দীর্ঘদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্য আমেরিকা-ইরানের দ্বন্দ্বে উত্তাল হয়ে আছে। চলতি বছরের শুরুতেই পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, যখন হোয়াইট হাউসের নির্দেশে ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়। এর জবাবে তেহরান ইরাকের দুটি মার্কিন বিমান ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যা এই উত্তেজনাকে এক নতুন ও চরম পর্যায়ে পৌঁছে দেয়।

এর আগে ইরানে শাসনব্যবস্থায় বেশ কয়েকবার পরিবর্তন  চেয়েছে ইসরায়েল। তবে এবার সব জল্পনা-কল্পনা ভেঙে দিয়ে এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সরাসরি বলেছেন, ‘ইরানের গর্বিত জনগণকে একটি মন্দ ও দমনমূলক শাসনব্যবস্থা থেকে মুক্তির জন্য রুখে দাঁড়াতে হবে।’

বিশ্লেষকদের মত অনুযায়ী, নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যই যেন ইরানে শুক্রবার (১৩ জুন) ইসরায়েল আকস্মিক বিমান হামলা চালায়।

এছাড়াও ইসরায়েল দাবি করে জানিয়েছে, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রের স্তম্ভ দ্রুত মাটিতে মিশিয়ে দিতেই আমাদের এই হামলা।

বিশ্লেষকদের মতে, এসব হুমকি ও হামলা উপেক্ষা করেই ইরানের সর্বেনেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি একাই লড়ে যাচ্ছেন ইরানের শান্তি ও সুরক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে।

খামেনি এক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘ইরানের শান্তিই আমাদের লক্ষ্য, আমাদের ইসলামি প্রজাতন্ত্র সুরক্ষায় আমরা আমরণ লড়ে যাবো।’

খামেনি মনে করেন, ‘জায়নবাদীদের সঙ্গে ইরান কখনোই আপস করবে না। ইসলামি প্রজাতন্ত্র কোনোদিন হার মানেনি, মানবেও না।’

কেন খামেনি?

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি- একজন ধর্মীয় নেতা, রাজনৈতিক কৌশলী এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্ব।

১৯৮৯ সাল থেকে টানা চার দশক ধরে তিনি ইরানের শাসনভার ধরে রেখেছেন। তার নেতৃত্বে ইরান শুধু একটি দেশ নয়, বরং একটি আদর্শিক বলয়ে পরিণত হয়েছে, যার প্রভাব তেহরান থেকে গাজা, বাগদাদ, দামেস্ক হয়ে সানা পর্যন্ত বিস্তৃত।

খামেনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৯ সালে, ইরানের পবিত্র নগরী মাশহাদে। তার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উত্থান শুরু হয় ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির ঘনিষ্ঠ শিষ্য হিসেবে। খোমেনির নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানের রাজতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটে এবং প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামি প্রজাতন্ত্র।

খোমেনির মৃত্যুর পর ১৯৮৯ সালে মাত্র ৫০ বছর বয়সে খামেনি দেশটির সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে দায়িত্ব নেন- যা ইরানের রাজনৈতিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তর। এর মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ, সেনাবাহিনী, ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি), এবং কুদস ফোর্সের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রক।

খামেনির শাসনামলে ইরান সরাসরি কোনো বড় যুদ্ধে না জড়ালেও, আঞ্চলিকভাবে তার প্রভাব ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। তিনি গড়ে তোলেন ‘অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স’- যার মধ্যে রয়েছে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাস, ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী, ইরাক ও সিরিয়ার শিয়া মিলিশিয়ারা। এদের মাধ্যমে ইরান এক প্রকার ‘ছায়া যুদ্ধনীতি’ অনুসরণ করে, যাতে নিজে সরাসরি সংঘাতে না জড়িয়েও আঞ্চলিক প্রতিপক্ষদের চাপে রাখে।

খামেনির শাসনামলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আন্তর্জাতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র, বহুবার এই কর্মসূচিকে ‘বিপজ্জনক’ ও ‘অস্থিরতা সৃষ্টিকারী’ বলে আখ্যায়িত করেছে। তবে খামেনি এটিকে জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।

সবকিছু পাল্টে যায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর। ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের ইসরাইল হামলার পর শুরু হয় গাজা যুদ্ধ। এ যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েল কেবল গাজাই নয়, ইরানের আঞ্চলিক মিত্রদের ওপরও একের পর এক হামলা চালাতে শুরু করে। এমনকি ইরানের ভেতরেও বিমান হামলা ও গুপ্তচরবৃত্তির ঘটনা ঘটে। এসব হামলায় আইআরজিসি-এর শীর্ষ কর্মকর্তারা নিহত হন, ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রও।

অনেক বিশ্লেষকের মতে, এই ঘটনাগুলো ইরানের ‘অজেয় ভাবমূর্তি’-তে প্রথমবারের মতো চিড় ধরায়।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একসময় খামেনিকে ‘সহজ লক্ষ্যবস্তু’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এই মন্তব্য শুধু ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়, বরং সরাসরি হত্যারও দিয়েছেন তিনি।

কেন ইরান?

বর্তমানে বিশ্বে আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশের সংখ্যা নয়টি। এই তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া এবং ধারণা করা হয় ইসরায়েল। এই দেশগুলো একাধিকবার পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়ে নিজেদের অস্ত্রের সক্ষমতা বিশ্বে তুলে ধরেছে।

অন্যদিকে, ইরান এখনো কোনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেনি কিংবা তার অস্ত্র মজুতের কথা ঘোষণা দেয়নি। ফলে এই তালিকায় ইরানের কোনো স্থান নেই।

তবে পারমাণবিক শক্তির দৌড়ে ইরান অন্যতম আলোচিত রাষ্ট্র। কারণ, তারা দীর্ঘদিন ধরে পারমাণবিক গবেষণা ও জ্বালানি উন্নয়নের নামে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ইরান এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, চাইলে অল্প সময়ের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে। একে বলা হয় ‘পারমাণবিক দ্বারপ্রান্তের দেশ’।

ইরানের বিজ্ঞানীরা ইউরেনিয়ামকে প্রায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধিত করতে সক্ষম হয়েছে, যেখানে অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রা প্রায় ৯০ শতাংশ।

বিশ্লেষকদের মতে, ইরান চাইলে মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অস্ত্রের মূল উপাদান প্রস্তুত করতে পারবে।

এছাড়া, ইরানের কাছে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিও রয়েছে, যা পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র বহনে সক্ষম হতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত ইরান সরকার সাফ জানিয়েছে যে, তারা এই অস্ত্র তৈরি করতে চায় না।

বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্ব ইরানের এই সক্ষমতাকে নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখছে। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ রয়েছে। আবার, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো নজরদারিতে রেখেছে।

ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ নয়। তারা অস্ত্রের মালিক নবম দেশগুলোর তালিকায় নেই। তবে পারমাণবিক প্রযুক্তিতে তাদের অগ্রগতি বিশ্বের কাছে এক ধরনের অশনি সঙ্কেত। এই কারণেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইরান বরাবরই আলোচনার কেন্দ্রে থাকে।

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইঙ্গিত?

মধ্যপ্রাচ্যের দুই প্রধান শত্রু- ইরান-ইসরায়েল, বর্তমানে এক গভীর সংঘাতের দিকে এগুচ্ছে, যা বিশ্বরাজনীতিতে উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই সংঘাত কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হতে পারে?

ইরান-ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ও সামরিক দ্বন্দ্বে জড়িত। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সম্প্রসারণবাদী নীতি ইসরায়েলের জন্য গুরুতর হুমকি। ইসরায়েল বারবার স্পষ্ট করেছে- ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনে বাধা দিতে তারা প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে।

মধ্যপ্রাচ্য আগে থেকেই সংকটপূর্ণ অঞ্চল। ইয়েমেন, সিরিয়া, লেবানন ও ইরাকসহ নানা স্থানে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। যদি বড় ধরনের সামরিক সংঘাত শুরু হয়, তবে এটি দ্রুত অন্যান্য দেশের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো- বিশেষ করে আমেরিকা, রাশিয়া ও চীন- মধ্যপ্রাচ্যে তাদের নিজস্ব স্বার্থ নিয়োজিত। এই কারণে ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত তাদের মধ্যেও কূটনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনা তৈরি করছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এখনো সরাসরি বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা খুব বেশি নয়, কারণ বড় দেশগুলো সাধারণত এমন পরিস্থিতি এড়িয়ে চলে। তবে ভুল বোঝাবুঝি, স্থানীয় সংঘাতের দ্রুত বিস্তার, এবং ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক অস্ত্রের মতো প্রযুক্তির উপস্থিতি যেকোনো সময় বিপর্যয়ের হাতিয়ার হতে পারে।



জুবায়ের দুখু, সাংবাদিকতা বিভাগ।


Comments