ট্রাম্পের হামলার পর ইরানের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন

 

ট্রাম্প ও ইরান-আমেরিকার পতাকা।

ইরানের গোপন পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাতারাতি হামলার পর, এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন- কতটুকু ধ্বংস হলো ইরান, আর কী অবশিষ্ট আছে? এই উত্তর নির্ধারণ করবে আগামী কয়েক দশক মধ্যপ্রাচ্যের চেহারা এবং ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব।

তবে এটি এমন একটি প্রশ্ন, যার উত্তর সহজ নয়। কারণ, ফোর্ডো-নাতানজ এবং ইসফাহানের মতো স্থাপনার কার্যক্রম নিয়ে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত হওয়ায় ইরান এসব স্থাপনাতেই সমস্ত গোপন কার্যক্রম রাখবে না- এমনটাই ধারণা।

জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা জানিয়েছে, ইরান ৮৩ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছে, যদিও ইরান দাবি করছে, তাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- যদি ইসরায়েলের দাবি সঠিক হয়, যে ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে, তাহলে এর জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ গোপন কোনো জায়গায় লুকিয়ে রাখা হতে পারে। কারণ, মাত্র ২০ কিলোগ্রাম উচ্চ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামই পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য যথেষ্ট। এমন উপাদান একটি ছোট গাড়িতেও বহন করা সম্ভব।

অন্যদিকে, ইসরায়েল গত দশ দিন ধরে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী ও সামরিক কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে ইরানের কমান্ড কাঠামো এবং গোপন কর্মসূচির বড় অংশ  এরই মধ্যে ভেঙে দেয়া হয়েছে। তবে কোনো হামলাই পুরোপুরি নিখুঁত নয়- তাই কিছু অজানা উপাদান এখনো কোথাও রয়ে যেতে পারে।

সাম্প্রতিক স্যাটেলাইট চিত্র এবং ধুলাবালি পরিষ্কার হলে হয়তো বোঝা যাবে, আরও কোথায় আঘাত হানা হয়েছে। তবে, যেকোনো পরিস্থিতিতে ইরানের পরমাণু উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরোধীরা (অধিকাংশ আন্তর্জাতিক মহল) এতে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেতে পারে।

এখন প্রশ্ন হলো, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির কোনো অংশ কি গোপনে রয়ে গেছে? বা তেহরান কি নতুন করে এগিয়ে যাবে? এখনই এই গোপন উপকরণ বের করে আনার সম্ভাবনা কম। কারণ, মার্কিন ও ইসরায়েলি নজরদারি তুঙ্গে রয়েছে।

ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘এখন শান্তির সময়!’— কিন্তু মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে আলোচনার মেজাজ অনেকটাই বদলে গেছে। আগে যেখানে ইরান সমৃদ্ধকরণ ত্যাগের ইঙ্গিত দিয়েছিল, এখন আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসতে পারে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি। কারণ, ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ইরান এরই মধ্যে শক্তিশালী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে এবং ইসরায়েলের অনেক ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার ধ্বংস করে দিয়েছে।

এখন ইরানের আলোচনার অবস্থানও বদলেছে। অনেক অস্ত্র ও প্রযুক্তি এরই মধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে বা ব্যবহৃত হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ- প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কীভাবে কৌশল নির্ধারণ করবেন।

তার আকাশপথ শত্রুপক্ষের দখলে, পারমাণবিক কর্মসূচি ক্ষতিগ্রস্ত, সামরিক কাঠামো দুর্বল। তাই তিনি সীমিত প্রতিক্রিয়ার পথেই হাঁটবেন- সরাসরি মার্কিন ঘাঁটিতে বড় হামলা করলে প্রবল পাল্টা প্রতিশোধের ঝুঁকি থাকবে। তাই ইরান হয়তো বরাবরের মতোই ছোট ছোট ছায়াযুদ্ধের পথে নামবে- ইউরোপের কোনো রাজধানী শহরে কিংবা হরমুজ প্রণালীতে আমরা এর নমুনা দেখতে পারি।

তবে ইরানের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত ধৈর্য এখানে বড় শক্তি। এখানে কোনো নির্বাচন নেই, তাই চাপও কম। ইরান ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে, আবার গুছিয়ে নেবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসও এই অঞ্চলে খুব বেশি সাফল্যের গল্প দেখায় না। বিগত ২০ বছরে সিরিয়া থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত তারা একের পর এক দেশ বোমাবর্ষণ করলেও, কোথাও স্থায়ী সাফল্য আসেনি। আফগানিস্তান থেকে অপমানজনকভাবে ফিরতে হয়েছে, সিরিয়ার সরকার আজও টিকে আছে।

ইরান কিন্তু ইরাক নয়। এই আক্রমণের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রেরও বড় কোনো আন্তর্জাতিক সমর্থন ছিল না। তাই ভবিষ্যতে কি হবে, তা অনিশ্চিত। কিন্তু একটি বিষয় নিশ্চিত- এই অঞ্চলে মার্কিন হস্তক্ষেপ নিয়ে সন্দেহ ও উদ্বেগ আরও বেড়ে গেছে।


জুবায়ের দুখু, সাংবাদিকতা বিভাগ।

Comments