দেশগুলো কেন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে?

 

একটি পারমাণবিক অস্ত্রের দৃশ্য। সংগৃহীত...

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত চলাকালে ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি উরসুলা ভন ডের লেইন এক টুইটে লিখেছিলেন, ‘ইরান কখনোই বোমা অর্জন করবে না।’ পরবর্তীতে, তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘আমরা ইরানকে একটি বিশ্বাসযোগ্য কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় গুরুত্বসহকারে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাই। কারণ আলোচনার টেবিলই অগ্রগতির একমাত্র কার্যকর পথ।’ এই বক্তব্যে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, পশ্চিমারা মনে করে কে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারবে এবং কে পারবে না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তাদের রয়েছে।

তারা এমন সরকারগুলোকে অপসারণের দায়িত্ব নেয়, যাদের তারা মনে করে তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করছে। এই লক্ষ্য পূরণে, তারা অনেক সময় জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাকে ব্যবহার করে, আবার কখনো সেই সংস্থাকেও উপেক্ষা করে একতরফাভাবে কাজ চালিয়ে যায়।

যেখানেই পশ্চিমারা হস্তক্ষেপ করেছে, সেখানেই তারা অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা কিংবা পরাজয় রেখে গেছে। কেবল তারাই নিরাপদ থাকে, যারা পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে নিজেদের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে পেরেছে।

ফলে এখন এক ধরনের অলিখিত নীতি গড়ে উঠেছে, ‘যদি তুমি পশ্চিমাদের বিরোধিতা করো, তাহলে টিকে থাকতে হলে তোমার পারমাণবিক অস্ত্র দরকার। আর না হলে- তাদের আধিপত্য মেনে নাও।’

ইরাক হামলা

২০০৩ সালের মার্চ মাসে ন্যাটোর নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা চালায়, মার্কিনীরা দাবি তোলে- ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র (WMD) রয়েছে। তাদের এমন মাহলা সে সময় সবাই বুঝতে পেরেছিল। কেননা ওই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতা থেকে সরানো। মার্কিনীরা সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করতে পেরেছিল। এ সময় তারা সাদ্দামকে বন্দি করে বিচারের আওতায় এনে ফাঁসি কার্যকর করেছিল।

কিন্তু ইরাক থেকে সে সময় কোনো  (WMD) আবিষ্কার করতে পারেনি আমেরিকা। ইরাক আক্রমণের আগেই বিষয়টি সবাই জেনে গিয়েছিল।

বিশ্লেষকদে ধারণা অনুযায়ী, আমেরিকা (WMD) নয় বরং ইরাকের তেলের উপর তাদের নজর ছিল।

এই ধারণা একটা সময় এসে মিলে গেল। মার্কিন বাহিনী ইরাকের তেল কেন্দ্রগুলোতে এখন মোতায়েন রয়েছে, যার কার্যক্রম মার্কিন কোম্পানিগুলো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতের পর থেকে প্রায় পাঁচ হাজার মার্কিন সেনা দ্বারা প্রায় এক লাখেরও বেশি ইরাকি নিহত হন এবং লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

লিবিয়া হামলা

১৯৬৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর, মুয়াম্মার গাদ্দাফি লিবিয়ায় পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি চালু করেন। ঠান্ডা যুদ্ধ- পরবর্তী সময়ে তিনি পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেন এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের লক্ষ্যে এগিয়ে যান। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে গাদ্দাফি একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি ত্যাগ করেন। তবে পারমাণবিক অস্ত্র না থাকায় লিবিয়া পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপের ঝুঁকিতে পড়ে।

২০১০ সালের শেষের দিকে শুরু হওয়া এবং ২০১১ সালে লিবিয়ায় ছড়িয়ে পড়া আরব বসন্তের সুযোগে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে লিবিয়ায় বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য শক্তি প্রয়োগের অনুমোদনের একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। এ সময় তারা লিবিয়াজুড়ে বিমান হামলা শুরু করে এবং গাদ্দাফির বিরোধী বাহিনীকে সমর্থন করে। এর পরপরই গাদ্দাফিকে উৎখাত করা হয়। এর এক দশকেরও বেশি সময় পরেও, লিবিয়া বিভক্ত রয়েছে এবং সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে।

উত্তর আফ্রিকার এক সময়ের সবচেয়ে সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ লিবিয়া এখন টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে। গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করার অন্যতম কারণ হিসেবে এখানেও আমেরিকানরা লিবিয়ার তেল সম্পদকে বেছে নেয়।

এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার সবচেয়ে বড় ভুল কী ছিল জানতে চাইলে বারাক ওবামা বলেন, ‘লিবিয়ায় হস্তক্ষেপ করে পরবর্তী দিনের পরিকল্পনা করতে ব্যর্থ হওয়া।’

আফগানিস্তান হামলা

টানা বিশ বছর ধরে আফগানিস্তানে অবস্থান করেও আমেরিকা কিছুই করতে পারেনি। তারা দেশটিকে সেই একই তালেবানের হাতে তুলে দিয়েছে, যাদের তারাই উৎখাত করেছিল।

পাকিস্তানই একমাত্র দেশ যারা উভয় পক্ষের সঙ্গে খেলা খেলতে নেমে লাভবান হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুসারে, আমেরিকান বাহিনী ফিলিস্তিনি প্রায় দু হাজার ৫০০ জনেরও বেশি নিহত এবং বিশ হাজারের কাছাকাছি মানুষকে  আহ। বিপরীতে প্রায় পঁয়তাল্লিশ হাজার আফগান প্রাণ হারিয়েছে।

ইউক্রেন-রাশিয়া

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর, ইউক্রেনের কাছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক অস্ত্রাগার ছিল, যার মধ্যে প্রায় ২০০০ কৌশলগত ওয়ারহেড, ১৭০টি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (ICBM) এবং কৌশলগত বোমারু বিমান ছিল।

১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং রাশিয়া ইউক্রেনের  মধ্যে ‘বুদাপেস্ট নিরাপত্তা আশ্বাস স্মারক’ স্বাক্ষর হয়।

চুক্তিটি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যেকোনো শক্তি প্রয়োগের আগে নিরাপত্তার তাগিদে তৈরি করা হয়। ধারণা করা হয়, এই চুক্তিই ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও বিদ্যমান সীমান্তকে সম্মান করার প্রতিশ্রুতিও দেয়।

এই চুক্তির ভিত্তিতে, ইউক্রেন তার সমস্ত পারমাণবিক অস্ত্র রাশিয়ার কাছে সমর্পণ করে এবং অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) স্বাক্ষর করে।

আজ ইউক্রেন ভূখণ্ড হারান একটি দেশে রূপান্তরিত হয়েছে এবং রাশিয়ার একের পর এক আক্রমণের মুখোমুখি হচ্ছে। যদি তারা তাদের পারমাণবিক অস্ত্র ধরে রাখতো তাহলে কি এটা ঘটত? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চুক্তি এবং প্রতিশ্রুতির কোনো অর্থ নেই।

উত্তর কোরিয়া কেন রাজা?

এদিকে উত্তর কোরিয়ার কিম জং উন সরকার কেবল পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী বলেই নিরাপদ ধারণা করা হয়। দেশটি বিচ্ছিন্ন এবং বিশ্বের সবচেয়ে নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু কোনো বৃহৎ শক্তি কখনো তাদের শাসন পরিবর্তন বা তাদের পারমাণবিক মজুদ ধ্বংস করার চেষ্টা করেনি। অথচ এই দেশটিই পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশগুলোর কাছে পারমাণবিক অস্ত্র প্রযুক্তি বিক্রি করছে বলে জানা গেছে।

উত্তর কোরিয়া বছরের পর বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়ে উন্নতমানের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে বলে ধারণা। এর ফলে তারা বিশ্বজুড়ে সতর্ক স্বরূপ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

এদিকে পশ্চিমারা কেবল নিষেধাজ্ঞা এবং হুমকি আরোপ করতে পারে, যা কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অর্থহীন।

ইরান হামলা

গত ১৩ জুন ইরানে আক্রমণ করা হয়েছিল, কারণ ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি হুমকি হিসেবে ভাবতে শুরু করেছিল।

যেহেতু তারা মার্কিন মিত্র, তাই ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র ধারণ অগ্রহণযোগ্য। তেহরান বিশ্বের সবচেয়ে নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত সরকারগুলোর মধ্যে রয়ে গেছে এখনো। আমেরিকার সঙ্গে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা চলছিল; তবে, আমেরিকার সমর্থনে ইসরায়েল একতরফাভাবে হামলার পদক্ষেপে সিদ্ধান্ত পরিবর্ত করতে বাধ্য হয় ইরান।

ইসরায়েলের পাশাপাশি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে আমেরিকা এই আক্রমণে যোগ দেয়। ইসরায়েলের এই হামলা বন্ধ না করে উল্টো ইইউ প্রেসিডেন্ট মন্তব্য করেন, ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র রাখার অনুমতি দেওয়া উচিত নয়।

গত ১২ জুন আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার বোর্ড সভায় তেহরানের বক্তব্য অনুযায়ী ‘তার পরমাণু বিস্তার রোধের বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করছে’। আর এটিই ইসরায়েল ইরানে আক্রমণের কারণ হিসেবে দেখিয়েছে।

এদিকে ইরান পারমাণবিক ধ্বংস করার জন্য মরিয়া হয়ে ট্রাম্প এবং নেতানিয়াহু। তারা উভয়েই মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ডের বক্তব্যও উপেক্ষা করেন।

তুলসি গ্যাবার্ড  এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছিলেন, ‘মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা’ এখনো বিশ্বাস করে যে- ইরান এখনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না, কেননা ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনি ২০০৩ সালে স্থগিত করা পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি অনুমোদন করেননি।’

যেসব জাতি ঐতিহ্যগতভাবে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভাবনার বিরুদ্ধে, কেবল তারাই শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকবে। তবে এর থেকে বাঁচতে হলে তাদের কাছে পারমাণবিক অস্ত্রের নির্ভরযোগ্য প্রতিরোধক থাকতে হবে।


জুবায়ের দুখু, শিক্ষার্থী সাংবাদিকতা বিভাগ

Comments